ধারাবাহিক প্রতিবেদন-৩: প্রভাবশালীদের দখলে ঢালচর
সাহেদ শফিক: জলবায়ুর পরিবর্তন আর মেঘনার করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে প্রতি বছর উদ্বাস্ত হচ্ছেন নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সন্দীপ, মনপুরা ও ভোলা জেলার হাজার হাজার মানুষ। এসব ভাসমান মানুষের বেশির ভাগেরই ঠিকানা এখন নোয়াখালীর মেঘনার বুকে জেগে ওঠা নতুন চর, বেড়িবাঁধ কিংবা আশ্রয়কেন্দ্র। জেগে ওঠা নতুন চরেও শান্তি নেই তাদের। জলদস্যু, লুটেরা, ভূমিদস্যুদের কবলে পড়তে হচ্ছে নদীভাঙ্গনের স্বীকার সর্বহারা এ সকল মানুষদের। এমনই একটি চরের নাম ঢালচর। উত্তাল সাগরের ভয়াল ছোবলে সহজ-সরল এই মানুষগুলোর জীবন যেখানে সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, সেখানে আরেক দল মানুষ তাদের উচ্ছেদ করে হয়েছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ । যাদেরকে তাড়ানো যায়নি তাদেরকে হামলা-মামলা, ধর্ষণসহ অমানুষিক নির্যাতন চলছে অনবরত। এবং সরকারি এ চরে ও বসিয়েছেন খামখেয়ালি ‘খাজনা’। নোয়াখালী ও ভোলা জেলার মধ্যবর্তী মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চরে প্রশাসনের তদারকি নেই , তাই নেই কোনও আইন-কানুন। জানা গেছে ১৯৬০ দিকে নদীভাঙনের স্বীকার শত শত ভূমিহীন এ মেঘনার বুকে আশ্রয় নিয়েছেন। এই চরে বর্তমানে চার হাজারের বেশি ভূমিহীন পরিবার বসবাস করছে। তারা জানিয়েছে, স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারের একজন সাবেক প্রভাবশালী সচিব, হাতিয়া ও মনপুরা উপজেলার কিছু প্রভাবশালী লোক এই চরের খাস জমি ও চর দখল করে গড়ে তুলেছে বড় বড় মৎস্য প্রজেক্ট। একখন্ড খাস জমি পাওয়ার আশায় বিচ্ছিন্ন এই চরটিতে শত জুলুম সহ্য করে টিকে আছেন তারা। সরকারিভাবে তাদের কেউ কোনও জমি বুঝে পাননি। আর পাবেন কিনা তারও নিশ্চয়তা কেউ দেয় না। তবুও তাদের চোখে দূরের বাতিঘর, একদিন সেখান থেকে কেউ আলো নিয়ে এসে তাদের স্বপ্নগুলো আলোকিত করে যাবেন। ১৯৮৭ সাল থেকেই এই চরে বসবাস করে আসছেন ৭০ বছর বয়সী মোমেনা বেগম। চরে বসবাসের দীর্ঘ জীবনে জলদস্যু বাহিনীর পাশাপাশি ভূমিদস্যুদের নির্মম নির্যাতনের সাক্ষী তিনি। নিজের ভাষায় তিনি সেসব নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। বলেন, ‘আঙ্গো হোলাইনেরে মাছিরে খাবা, মশারে খাবা, বাগানে বাগানে হোলাইনে রাতে রাত কাটা দিনে দিন কাটা, কী হাপে খাইবে না হোকে খাইবে এদিকে চান না। এখন আন্নেরা আছেন আর ওপরে আন আল্লাহ আছেন।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই বৃদ্ধা বলেন, ৩০টি বছর বন ও জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করেও সরকারের এক খন্ড খাস জমির মালিক হতে পারছেন না। অথচ এই জমির মালিক হওয়ার সংগ্রামে তাকে বহুবার সম্ভ্রমহানির শিকার হতে হয়েছে। হামলা মামলা ও অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে স্বামী-সন্তানসহ সবাইকে। কষ্টে উপার্জিত টাকায় তৈরি করা দীর্ঘদিনের বসত ভিটা এখন চোখের নোনাজলে ভাসিয়ে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে এই বৃদ্ধা। তিনি জানান, প্রভাবশালীদের নির্যাতন আর নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিসহ বহু মানুষকে জানালেও কেউ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমন পরিণতি শুধু মোমেনা বেগম নয়, তার মতো আরও জুলুমের শিকার হয়েছেন আয়েশা খাতুন, আমেনা বেগম, জান্নাতুল ফেরদাউস, ফতেমা বিবিসহ অনেকেই। নদীভাঙার কারণে সর্বস্ব হারিয়ে বিগত ৬০ বছর ধরে প্রকৃতি, ভূমিদস্যু ও জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক টুকরো খাস জমিতে বেঁচে থাকার আশায় আছেন তারা। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের নির্মম এক ঘটনার বর্ণনা দেন রোকেয়া বেগম। বলেন, ‘এক রাতে ক্যাম্পে ভাত পাক করতে গিয়া তিনজন পুলিশ আমার ওপর ঝাঁপায়ে পড়ে। আমি রাজি না। ওরা ছাড়ে না। নির্যাতন করার কারণে আমার নয় হাজার টাকা ওষুধ খরচ গেছে। জোরে ব্লাড (রক্ত) ছুডেছে। কেউ একটু ধরতেও আসেনি।’ বলতে বলতেই শিউরে উঠে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। রাত হলে ডাকাতদের ভয়ে থাকেন ঢালচরের নারীরা। এমন ডাকাতদের হাতে সম্ভ্রম খোয়ানোর আরেক রাতের বর্ণনা দেন রোকেয়া। তিনি বলেন, ‘এক রাতে তারা আমার ঘরে ঢোকে। ডাকাত বুঝে আমি চিৎকার করতে গেলেই তারা আমার মুখ চেপে ধরে। আমি আর কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। প্রতিকারহীন এসব মানুষের চিৎকারে চরের বাতাস হাহাকার তুললেও নরপশুদের অত্যাচার থামে না। তাই নীরবে সব যন্ত্রণা সহ্য করে আসছেন তারা দীর্ঘদিন ধরে শুধু একখন্ড জমি পাওয়ার আশায়। কিন্তু, প্রশাসন আর প্রভাবশালীদের চক্করে সে আশায়ও যেন গুড়েবালি! রোকেয়া বলেন, ‘চরে এসেছি শুধু একটু আশ্রয়ের জন্য। এখন যদি এখানেও না থাকতে পারি তাহলে আর কী করবো। পাশে নদী আছে, সেখানে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর আমাদের কোনও উপায় নাই।’ এ সময় এগিয়ে আসেন ষাটোর্ধ্ব এক নারী। জলদস্যু, ভূমিদস্যুদের আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা এই নারীর নাম শাহেনা আক্তার। তিনি শরীরের কিছু ক্ষত দেখিয়ে বলেন, ‘আরও আছে, দেখাতে পারবো না। ওরা আমার ওপর অত্যাচার করেছে। আরও অনেক মা-বোনের ওপর অত্যাচার করেছে। এখনও করে।’ অঝোরে কাঁদলেন তিনি। তার কান্নায় চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চরের নির্যাতিত অন্য নারীরাও। তারাও মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছেন এমন যন্ত্রণার আঘাত। কিন্তু কাকে বলবেন? এ তো লজ্জার! অপমানের! আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ সমস্বরে অভিযোগ জানান, ‘বহুবার জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছি। তারাও আমাদের কোনও সাহায্য করেন না। পুলিশকে দেখিয়ে দিয়ে দায় সারেন। কিন্তু পুলিশ কোনও সহযোগিতা করে না।’ এ সময় স্ত্রীকে নির্যাতনের কাহিনি জানালেন এনায়েত উদ্দিন নামের এক প্রৌঢ়। তিনি বলেন, হাতিয়ার সাহেবানী এলাকায় আমাদের বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনের কারণে ১৯৯০ সালের দিকে এই চরে এসে থাকতে শুরু করি। বড় লজ্জার কথা। নতুন বিয়ে করে স্ত্রীসহ চরে আসার পর এক রাতে পাশের বাগান থেকে একদল ডাকাত এসে দুইটা ফায়ার করে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এরপর প্রথমে আমার ঘরের দরজা লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে। মনে করেছিলাম নতুন বিয়ে করেছি, ডাকাতরা স্বর্ণালঙ্কার নিতে এসেছে। কিন্তুদেখি উল্টা। তারা আমাকে বেঁধে ফেলে, এরপর…।’ আর শোনার বা শোনানোর দরকার পড়ে না। এনায়েত উদ্দিনের চোখের পানি মুখ বেয়ে টলমল করে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। থেমে থেমে হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। ক্ষোভে কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল বলেন, ‘এসব বলে আর লাভ নাই। গরিবের লাই (জন্য) কোনও সরকার নাই।’ তবে অভিযুক্তদের কাউকে ঠিক সামনে পাওয়া গেল না। দেখা গেছে সাবেক সচিবসহ প্রভাবশালীদের দখলে থাকা জায়গা ও মাছের ঘের। আর লাল অট্টালিকার পথ।